বটগাছের জন্মকথা
The story of the banyan tree
অনেক অনেক দিন আগে এক দেশে এক রাজা ছিলেন। রাজার নাম ছিল বিদুর।
তিনি তাঁর দেশের মানুষদের খুব ভালোবাসতেন। দেশ জুড়ে ছিল সুখ আর শান্তি।
কোনো মানুষের অভাব হলে, অসুখ হলে রাজা সাথে সাথে তার খোঁজ-খবর নিতেন।
পাইক-পেয়াদারা প্রজাদের দেখাশুনা করত। পণ্ডিতগণ যত্নের সাথে শিশুদের পড়াতেন।
সেই গ্রামের কুমোর, তাঁতি, কৃষক, কামার, জেলে যার যার কাজ নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করত।
সেই গ্রামের দক্ষিণ দিকটা ছিল পাহাড় দিয়ে ঘেরা। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গ্রাম, ফসলের খেত আর বাগান। পাহাড়ের ওপারে সাগর। হঠাৎ একদিন সাগরের মধ্য থেকে উঠে আসে এক বিরাট দৈত্য।
পাহাড় পেরিয়ে দৈত্যটি গ্রামে ঢুকে পড়ে। ভয়ে গ্রামের মানুষ ছুটোছুটি শুরু করতে লাগলো । এ দেশে কেউ কোনো দিন এমন বিপদ দেখেওনি কিংবা শোনেওনি।
দৈত্যটির সামনে গরু, ছাগল, ভেড়া, মোষ যা পড়ছে তাই সে গিলে খেয়ে ফেলছে। ঘরে ঘরে কান্নার রোল- চারদিকে মানুষের মধ্যে হাহাকার।
রাজার কাছে খবর গেল। রাজা তো মহা অস্থির। এমন শান্তির দেশে এ কেমন মহাবিপদ! মন্ত্রী, রাজকর্মচারীদের নিয়ে রাজা সভায় বসলেন।
তাঁরা এক বাক্যে বললেন, 'মহারাজ দৈত্যটাকে মারার জন্য সৈন্য পাঠানো দরকার।' সৈন্যদের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে গেল।
হাতি, ঘোড়া, তীর, তলোয়ার, বল্লম নিয়ে সৈনারা যাত্রা করল। যথাসময়ে পৌঁছে গেল সৈন্যের দল। শুরু হল দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধ।
তীর, বল্লম ও তলোয়ারের আঘাতে কিছুই হয় না দৈত্যের। হঠাৎ দৈত্যটি আকাশ ফাটিয়ে গর্জন করে ওঠে। সেই শব্দে হাতি, ঘোড়া আর সৈন্যরা সব অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
সুযোগ পেয়ে দৈত্য যত হাতি আর ঘোড়া ছিল, সবগুলোকে একে একে খেয়ে ফেলে।
দৈত্যটি বড় তালগাছের মত লম্বা। বিশাল থামের মতো পা, খড়ের গাদার মতো মাথা আর আগুনের ভাঁটার মত দুটো চোখ দৈত্যটির।
অনেকক্ষণ পর একে একে সকল সৈন্যের জ্ঞান ফিরে আসে। সৈন্যরা ভয়ে কাঁপছে। জীবনে তারা কোনোদিন এমন অদ্ভুত বিশাল দৈত্য দেখেনি।
সৈন্যদের নড়াচড়া দেখে দৈত্যটি থপথপ করে পা ফেলে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তার পায়ের ভারে থর থর করে মাটি কেঁপে ওঠে।
দৈত্যটা ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, 'তোমাদের কোন ভয় নেই। আমি মানুষ খাই না। তোমাদের রাজাকে আমার কাছে আসতে বল। তার সঙ্গে আমার কথা আছে।'
আমি এক্ষুণি দৈত্যের কাছে যাব। সবাই রাজাকে বারণ করছে, *মহারাজ আপনি যাবেন না। দৈত্যটা ভয়ঙ্কর। ' রাজা কারো কথা শুনলেন না।
ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি দৈত্যের সামনে এসে দাঁড়ালেন। দৈত্যকে দেখে বললেন, আমিই এই দেশের রাজা।
তুমি আমার সঙ্গে কী কথা বলতে চাও?' দৈত্য হুঙ্কার দিয়ে বলে, "শুনুন মহারাজ, সাগরে আমার বাড়ি ঘর। ওখানে আমি আর যাব না।
এখানেই ওই পাহাড়ের পাশে আমি থাকব। আমি আপনার দেশের আর কোনো ক্ষতি করব না। তবে, প্রতিদিন ভোরে আমার খাওয়ার জন্য একটি করে মোষ অথবা গর্ পাঠাতে হবে।'
যাবার না পাঠালে আমি আপনাদের শান্তিতে থাকতে দেব না।" “তাই হবে। তবে আমার প্রজাদের তুমি কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ কথা বলে রাজা রাজমহলে ফিরে গেলেন। সারা দেশে আদেশ জারি করলেন, প্রজারা যেন প্রতিদিন ভোরে একটি করে মহিষ অথবা গরু দৈতাকে দেয়।
এমনি করেই দিন যেতে লাগল। কিছুদিন পর রাজ্য জুড়ে হাহাকার দেখা দিল। গরু-মহিষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। চাষীরা জমি চাষ করতে পারছে না। মাঠে ফসল নেই।
শিশুরা দুধ পায় না। সারা দেশ জুড়ে খাবার অভাব। রাজা নিজের গোলা থেকে প্রজাদের সাহায্য করলেন। কিন্তু একদিন তাও ফুরিয়ে গেল। রাজমহলেও খাদ্যের অভাব।
দয়ানু রাজা প্রজার দুঃখে মন ভার করে থাকেন। সারাক্ষণ শুধু এই বিপদ থেকে উদ্ধারের উপায় লোজেন। মন্ত্রীরাও কোনো উপায় বলতে পারে না।
এমনি এক সকাল। রাজা রাজমহলের বাগানে অস্থিরভাবে পায়চা করছেন। এমন সময় সোনার কাঠি হাতে লম্বা জামা পরা এক লোক রাজার সামনে এসে দাঁড়াল।
লোকটি কাঠিটা হাত দিয়ে ধরে বলল, জয় হোক, মহারাজ। রাজা চোখ তুলে তাকালেন তার দিকে। 'কে তুমি?' আমি এক যাদুকর, মহারাজ।
"শুনেছি আপনার রাজো মহাবিপদ দেখা দিয়েছে। তাই আপনার কাছে এলাম। আমার ইচ্ছে আপনার বিপদে সাহায্য করি।
মহারাজ যদি দয়া করে আমাকে সব কথা খুলে বলেন, তবে এই যাদুর কাঠি দিয়ে আমি চেষ্টা করে দেখব, কিছু করতে পারি কিনা।”
রাজা তাকে দৈত্যের অত্যাচারের কথা জানালেন।
যাদুকর খুব বিনয়ের সঙ্গে রাজাকে বলল,
মহারাজের যদি কষ্ট না হয় তবে আমাকে কি ওই দৈত্যের কাছে নিয়ে যাবেন??
রাজা তাকে নিয়ে যেতে রাজি হলেন। পেয়াদাদের হুকুম দিলেন দুটো ঘোড়া আনতে। ঘোড়া দুটো ছুটে চলেছে। একটার পিঠে রাজা, অপরটির পিঠে যাদুকর।
এক সময় তাঁরা দৈত্যের কাছে পৌঁছে গেলেন। দৈত্যটা তখন কান ফাটানো শব্দে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। রাজা ও যাদুকর ঘোড়া থেকে নামলেন।
যাদুকর বলল, 'মহারাজ, আপনি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ান।' রাজা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন যাদুকর কী করে।
যাদুকর তার সোনার কাঠিটাকে মাটিতে ছুঁইয়ে দৈত্যের চারিদিকে দাগ দিল। দৈত্যটা তখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। সৈত্যটার মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো যাদুকর।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কাঠিটা দৈত্যের মাথার ওপর রাখল। মুহূর্তেই ঘুম ভেঙে গেল দৈত্যের।
“কে তুমি? অসময়ে আমার ঘুম ভাঙালে ?”
যাদুকর কাঠিটা দৈত্যের চোখ বরাবর ধরে বলল, "আমি তোমার যম। আজ থেকে তোমার দিন শেষ। মুহূর্তের মধ্যেই ভয়ঙ্কর দৈত্যটি যেন চুপসে গেল।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যাদুকরের সামনে হাত জোড় করে বসে বলল, 'হুজুর! আমাকে আপনি প্রাণে মারবেন না।
"আমি আর মানুষের ক্ষতি করব না। আমি আবার সাগরে ফিরে যাচ্ছি। কোন দিন আর এ রাজ্যে আসব না।' যাদুকর বলল, ‘তুমি যে অন্যায় করেছ তার শাস্তি তোমাকে ভোগ করতেই হবে। এই পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন ধরে তোমাকে আমি বাঁচিয়ে রাখব। তবে এখন থেকে বটগাছ হয়ে তুমি পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে। তুমি শীতল ছায়া দেবে। তোমার তলায় বসে মানুষ বিশ্রাম নেবে। পাখিরা তোমার ফল খাবে, গাছে বাসা বাঁধবে। শিশুরা তোমার ছায়ায় খেলা করবে। এই তোমার শাস্তি। আর মহারাজ, আপনাকেও আমার একটা অনুরোধ- কোনোদিন আপনি বটগাছ কাটবেন না। এ বটগাছ কাটলে এলাকার বাতাস ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে যাবে। পাখিরা থাকবে না। মাঠের ফসলের ক্ষতি হবে। *
রাজা যাদুকরের কথামতো বটগাছটিকে বাঁচিয়ে রাখলেন। কোনোদিন এর একটি ডালও কাউকে কাটতে দিলেন না। গ্রামবাসীর মনে শান্তি ফিরে এল।
0 comments: