খুকুর সাধ | The dog is sad Bangla Golpo 2024


খুকুর সাধ

আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে বড় একটা মাটির পথ। ঠিক পশ্চিমে বাড়ির কোল ঘেঁষে ফসলের মাঠ। পথটি এঁকেবেঁকে মাঠের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। পথের শেষ কোথায়? হয়তো বা তেপান্তরের মাঠে গিয়ে। সেই মাঠ পেরিয়ে গেলেই বুঝি বা এক সোনার দেশ। যেখানে রাজা আছে, রাজকন্যা আছে। হাতি, ঘোড়া, সৈন্যসামন্ত স-ব আছে। হাজার দুয়ারি শ্বেতপাথরের রাজবাড়ি। সেখানে দিঘির জলে পদ্ম ফোটে। 
রাজার বাগানে ক-ত রকমের থরে থরে সাজানো ফুলের বাহার। রাজকন্যে সাথীদের নিয়ে ফুলবাগানে ঘুরে বেড়ায়। সখীরা মিলে গান গায়।

এমন সময় মায়ের ডাক, 'খুকু, কোথায় গেলি! জলদি আয়, ভাত জুড়িয়ে গেল যে।
দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসি। ভাত খেতে খেতে মাকে বলি, 'আচ্ছা মা, বাবা আসেন না কেন? আমার না, বাবাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। মা কোনো কথা না বলে আমার গরম ভাতে বাতাস দিতে থাকেন। আমি আর কোনো কথা বলি না। মার কাছে শুনেছি, ১৯৭১ সনে দেশ স্বাধীন করার জন্য বাবা যুদ্ধে যান। তারপর বাবার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমার বিশ্বাস, বাবা আছেন। একদিন তিনি ঠিক ঠিক ফিরে আসবেন।

বিকেলে গাছের ছায়া পড়ে পথের ওপর। আমি তখন গিয়ে দাঁড়াই। পথটা পূর্ব দিক ধরে গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। অনেক, অনেক দূর।পথ যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেইখানে বুঝি আছে এক শহর। বাবা ঠিক সেই শহরে থাকেন। আমি ভাবি, হাঁটতে হাঁটতে একদিন সেই শহরে চলে যাব। বাবার কোলে বসে বলব, বাবা, তুমি এত দূর শহরে থেকো না। বাড়িতে চলে এস। তুমি রোজ রোজ গল্প বলবে, আর আমি শুনব। বাবা! তোমাকে ছাড়া আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। ভাবতে ভাবতে কখন যেন সময় চলে যায়। শেষ বিকেলের আলোর রেখা যাই যাই করে। মসজিদ থেকে মাগরেবের আজান ভেসে আসে।

এমনি করেই দিন কাটে। মা বললে কাজে সাহায্য করি। বন্ধুদের বাড়িতে চলে যাই খেলা করতে। ওরাও আসে। পুতুল খেলি। চড়ুই- ভাতি করি। আমাদের বাড়িটা বেশ বড়। পুকুরের ওপারে বড়সড় একটা জঙ্গল। সেখানে অনেক রকম বুনোফল ধরে। ছোট ছোট গাছে টুনটুনি, দোয়েল আর বুলবুলি বাসা বাঁধে। সেখানে বন্ধুরা মিলে দল বেঁধে যাই। একা যাই না। কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। সকালে আর বিকালে জঙ্গলটায় পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভরা থাকে। দুপুরবেলায় কেমন যেন চুপচাপ ঝিমোয়। মাঝেমধ্যে ঘুঘুর একটানা ডাক শোনা যায়। রাতের জঙ্গল কেমন যেন শান্ত, নির্জন।

একদিন আমার বন্ধুরা এসে বলল সামনের মাস থেকে আমরা স্কুলে ভর্তি হব। তুই হবি না?
আমি এ কথার কোনো জবাব দিই না। সকলের মধ্যে একটা উত্তেজনা। সাজ সাজ রব। নতুন জামা এসেছে, খাতা এসেছে। রাতে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে বলি, 'মা, সামনের মাসে আমার বন্ধুরা স্কুলে ভর্তি হবে। আমিও হব।' মা আমাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
'সামনের মাস তো আসুক। তখন দেখা যাবে। আমি অপেক্ষা করতে থাকি। নতুন জামা আসে না। খাতা আসে না। মাও কিছু বলেন না। আমি মায়ের কষ্টটা কেমন করে যেন টের পাই। 
আমিও কিছু বলি না। শুধু মনের মধ্যে একটা আশা নিয়ে দিন গুনতে থাকি।

আমার বড় বোনের রেখে যাওয়া একটা স্লেট ঘরে ছিল। স্লেটটা নিয়ে পাশের বাড়ির দিনু আপার কাছে মাঝে মাঝে যেতাম। দিনু আপা আমাকে পড়তে, লিখতে ও অঙ্ক করতে শেখাতেন। ঘরে বসে আমি আমার অবসর সময়ে যা মনে আসত তাই লিখতাম। বাবার কাছে আমি প্রায়ই চিঠি লিখি। আমার মনে হয় বাবা দূর শহরে বসে আমার চিঠিগুলোর কথা শুনতে পান। বাবার চেহারা দেখেছি কিনা মনে নেই। 
কিন্তু আমার মনে বাবা ছিলেন অনেক লম্বা, সুন্দর একটি মানুষ। মনে তাঁর অনেক মায়া। আমি যেমন তাঁকে ভালোবাসি, তিনিও তেমনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। বাবা আসেন না। তবুও মনে হয়, বাবা সারাক্ষণ আমার আশেপাশেই আছেন। আমার বন্ধুরা স্কুলে ভর্তি হয়ে যায়। তারা আমাকে স্কুলের গল্প বলে। নতুন নতুন বন্ধুদের নাম বলে। আমি শুধু শুনি। মনের মধ্যে চাপা একটা দুঃখ নিয়ে থাকি। 
মাকেও আর বিরক্ত করি না। স্লেটে আমি বাবার কাছে বেশি বেশি করে চিঠি লিখি। দিনু আপার কাছে যাই। অঙ্ক শিখি। পড়া শিখি আর লিখি।

মাস প্রায় শেষ। স্কুল পুরোদমে চলছে। একদিন মা আমাকে বললেন, 'আমার সঙ্গে চল!"
আমি বলি, 'কোথায় মা?  "স্কুলে।'
পরিষ্কার একটা জামা পরে মায়ের সঙ্গে চললাম। মা আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে প্রধান শিক্ষকের ঘরে ঢুকলেন। আমি স্কুলের বারান্দা দিয়ে দেখি ছেলেমেয়েরা ক্লাসে ক্লাসে বসে আছে। সারা স্কুল জুড়ে আনন্দের পরিবেশ। মাঠটা সবুজ ঘাসে ঢাকা। স্কুলের সীমানা ঘেরা পাঁচিল। মাঠের চারপাশ দিয়ে ফুল ফুটে আছে।

এমন সুন্দর স্কুল! মা কি সত্যি সত্যি আমাকে এই স্কুলে ভর্তি করে দেবেন? মনের মধ্যে তবুও একটুখানি আশা। মা যখন এসেছেন, একটা কিছু হবেই। এমন সময় প্রধান শিক্ষকের ঘরে আমার ডাক পড়ল। তিনি আমাকে স্নেহের সুরে বললেন, 'এখানে পড়বে?' আমি শুধু মাথা নেড়ে বললাম, 'জি!
স্কুলের খাতায় আমার নাম উঠল। নিয়মিত আসি। দিনু আপার কাছে পড়ার ফলে ক্লাসের বইগুলো আমার কাছে সহজ মনে হয়। শিক্ষকরা আমাকে আদর করেন। উৎসাহ দেন। আমি পড়াশুনায় ভালো- এমন একটা সুনাম স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে।

আমাদের অভাব আছে। মা বুঝতে দেন না। খুব হিসেব করে চলেন। তবুও টান পড়ে। জামাকাপড়ে। খাতাপত্রে। বই কিনতে। কোনোমতে চলে যায়। অন্যের সহযোগিতায়, বই ধার করে প্রতিদিনের পড়া ঠিকমত করি। বাবাকে প্লেটে লিখে আমি জানিয়েছি আমার খুব পড়াশুনা করতে ইচ্ছে করে। 
বাবাকে কথা দিয়েছি আমি পড়ব, অ-নে-ক পড়ব, অ-নে-ক। কিছুদিন হল আমার প্রায়ই স্কুল কামাই হয়। অভাবের কারণে। বাড়ির নানা কাজের জন্য। একদিন সকালে হেড স্যার আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। আমাকে ডাকলেন, 'খুকু, এদিকে এসো।' আমি ভয়ে ভয়ে কাছে যাই। স্যারের একটা হাত আমার মাথায়। মাকে ডেকে বললেন, 'খুকুকে এখন থেকে নিয়মিত স্কুলে পাঠাবেন। ওর পড়াশুনার সব দায়দায়িত্ব আমাদের।

মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে দিনু আপাকে খবরটা দিয়ে আসি। মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। 
মায়ের মুখে আনন্দের হাসি। কত দিন মায়ের এমন হাসি দেখি না। গাছের পাতায় পাতায় তখন সকালের সূর্য আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। ঝকঝকে সুন্দর সকালের মিষ্টি আলোয় ভরে গেছে আমাদের সারা বাড়ি। আমি ঘরে ঢুকে স্লেটটা নিয়ে বাবাকে চিঠি লিখতে বসি।

স্কুলে যাই। আমার সবটুকু সময় যেন আনন্দে ভরা। পড়ি, খেলা করি। পথে গিয়ে দাঁড়াই। বাবার জন্য অপেক্ষা করি। স্লেটে প্রতিদিন চিঠি লিখি। এবার আমার পাঠশালার শেষ বছর। বৃত্তি পরীক্ষা দেব। খুব করে পড়ছি। একদিন পরীক্ষাও শেষ হয়। এখন ফলের জন্য অপেক্ষা। যথাসময়ে ফল বের হয়। 
বৃত্তি পেয়েছি। হেড স্যার বাড়িতে এসে মাকে বলেন, 'খুকু আমাদের মান রেখেছে। ওর যতদূর ইচ্ছে পড়বে। গ্রামের সবাই মিলে খুকুর লেখাপড়ার ভার নিয়েছে। মায়ের মুখে হাসি আর আনন্দের অশ্রু টলটল করছে। আমার সকল খুশি জানানোর জায়গা তো মাঠ আর পথটা। মাঠে ছুটে যাই। যতদূর চোখ যায় হলুদ সর্ষে ফুলে মাঠ ভরে আছে। শেষ বিকেলের সোনার আলোয় ফুলগুলো যেন সোনায় মোড়ানো বলে মনে হয়।

চারিদিকে মৌমাছিদের গুন গুন গান। সন্ধ্যা হয় হয়। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসি। আলোটা জ্বেলে নিয়ে বাবাকে চিঠি লিখতে বসি। বাবাকে বৃত্তি পাওয়ার কথা জানাই। আমার ভালো লাগার কথা বলি। বাবাকে লিখি তাড়াতাড়ি চলে আসতে। মনের মধ্যে জমে থাকা কথা লিখতে লিখতে স্লেটটা ভরে যায়। 
মা রান্না ঘর থেকে ডাক দেন, 'খুকু খেতে আয়। খেতে খেতে মাকে বলি, 'মা আমি কিন্তু অনেক পড়ব। অনে-ক। তুমি পাশে থাকলে আমি স-ব পারব।

Similar Videos

0 comments: