জ্যোৎস্নারাতের ভূত Ghost of Jyotsnarat Bangla golpo লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
জ্যোৎস্নারাতের ভূত Ghost of Jyotsnarat Bangla golpo লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

জ্যোৎস্নারাতের ভূত | Ghost of Jyotsnarat Bangla golpo


জ্যোৎস্নারাতের ভূত

সন্ধ্যা তখনও নামেনি। সূর্য ডোবে ডোবে। সূর্যের আলোর শেষ রেখা গাছের ওপর এসে পড়েছে। সোনালি আলোয় পাতাগুলো ঝিকমিক করছে। মা দিনের কাজগুলো শেষ করার জন্য খুব ব্যস্ত। ঠিক তখনই বাক্সপ্যাটরা নিয়ে আমার বড় ভাই শাওন হাজির। শাওনদাদা ঢাকায় থাকেন। 
পড়াশোনা করেন। অনেক দিন পরে বাড়িতে এলেন। দাদাকে দেখে আমি তো মহাখুশি। দাদা দৌড়ে এসে 'আমার পারুল বোন কই রে!' বলেই আমাকে কোলে তুলে নেন। মায়ের আনন্দমাখা চোখদুটো পানিতে টলটল করে ওঠে।

বাবা তখন বাড়ি ছিলেন না। হাটে গিয়েছেন। ফিরে এসে দাদাকে দেখে বাবাতো খুশিতে ডগমগ। 
আর আমি, সারা সন্ধ্যা দাদার কোলে বসে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছি। রাত বাড়তে লাগল। খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা যার যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছি। শেষ রাতের দিকে হঠাৎ শুনি আমাদের কাছারি ঘরের দরজায় খট খট শব্দ।

সকলের ঘুম ভেঙে গেছে। দাদা জোরে জোরে জিজ্ঞেস করেন,
'কে? কে ওখানে? কাকে চাই?'
ওপাশ থেকে উত্তর আসে,
'আমি খোকন, খোকন বলছি।
খোকন আমার একমাত্র মামা। আমাদের গ্রাম থেকে মাইল দুই দূরে আমার নানাবাড়ি। এই সময়ে খোকন মামার গলার আওয়াজ পেয়ে দাদা ভয়ে ভয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

কী ব্যাপার, মামা, এত রাতে কেন? কী হয়েছে বল তো?'
কাঁপা-কাঁপা গলায় দাদা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো জিজ্ঞেস করে। মা তো ভয়ে অস্থির। নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ হবে। না হলে এত রাতে খোকন মামা আসবেন কেন?

মামা মাকে বললেন,
'বুবু, আব্বার কথা তো জান। মাঝরাতে উঠে হাউমাউ করে কান্না। কী ব্যাপার, কী হয়েছে। না, কোনো কথা নয়, আমি এক্ষুণি পারুলকে দেখতে চাই।'
মা বললেন,
'ঠিক আছে, সকাল হোক, তারপর রওনা দে।'
মামা বললেন,
'না বুবু, শাওন যখন এসেছে তখন আর কোনো চিন্তা নেই। আমরা এখনই রওনা দিই। ভোর হওয়ার আগেই আব্বার কাছে পারুলকে নিয়ে যেতে হবে। 
আব্বার কথা তো জানোই, না জানি আবার কোন কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন।'
আমার ঘুমঘুম ভাব অনেক আগেই কেটে গেছে। মা আমাকে কাপড়চোপড় পরিয়ে দিয়ে মামাকে বললেন, 'রাত-বিরেতের পথ, সাবধানে যাস।'
তখন ফাল্গুন মাস শেষ হয় হয়। দক্ষিণা বাতাস বইতে শুরু করেছে। বাইরে অল্প অল্প হিমহিম ভাব। তিনজন বেরিয়ে পড়লাম। ফুটফুটে জ্যোৎস্নার আলো। কুয়াশা নেই। 
চারিদিকে চুপচাপ। মাঝে-মধ্যে দূর থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসে। আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছি। গাছের পাতায় পাতায় জ্যোৎস্নার আলো পড়ে ঝলমল করছে।

আমাদের চলার পথের বামদিকে দেবদারু, আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি আর বাঁশঝাড়ের বাগান। ডানদিকে খোলা মাঠ। মাঝে মাঝে কিছু কিছু ন্যাড়া-মাথা কলাগাছ দাঁড়িয়ে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মামাবাড়ির গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছি। ভারি সুন্দর জ্যোৎস্নামাখা রাত। এমন সময় দক্ষিণা বাতাসের এলোমেলো ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ে। বাগানের গাছগুলো দোল খেতে থাকে।

নিঃশব্দ রাত যেন হঠাৎ করে হৈ হৈ শব্দে মেতে ওঠে। ফাল্গুনের ঝরাপাতার সর সর শব্দ। শিশিরের টুপটাপ, বাঁশঝাড় থেকে কান্নার মতো কোঁকানো শব্দ ভেসে আসে। ঝাউগাছ যেন বাতাসের ছোঁয়ায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। মামার হাত ধরে আমি হেঁটে চলেছি। পাশে পাশে দাদা। হঠাৎ মামা আমার হাতটা জোরে চেপে ধরেন। থর থর করে কাঁপছেন। বাঁ হাত দিয়ে দাদাকে জড়িয়ে ধরে তোতলাতে তোতলাতে বলেন, 'শা-শা- শাওন, ভূ-ভূ-ভূত।' ভয়ে আমি সিঁটকে গেছি। বুকটা দুরু দুরু করছে।

গলা শুকিয়ে কাঠ। কোন কথা বলতে পারছি না। মামার অজ্ঞান হয় হয় অবস্থা। দাদা এক ঝটকায় মামার হাত ছড়িয়ে নিয়ে বলে, ভয় পেয়ো না, মামা, আমি দেখছি। দাদা রাস্তার পাশের গাছ থেকে একটা ডাল ভেঙে নিয়ে আসে। লাঠি হাতে নিয়ে মামাকে বলে, 'মামা, কই তোমার ভূত?'
মামা কাঁপা-কাঁপা হাত তুলে দেখান, 'ও- ও ওই যে।' আমিও মামার দেখানো ভূতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। সত্যি সত্যি একটা বিদঘুটে আকারের ভূত দাঁড়িয়ে আছে। সাদা ধবধবে শাড়ি পরা। মাথা নেই। বড় একটা জিব। জিবটা লকলক করছে। ওপরে তোলা দুটো হাত। যেন আমাদের ডাকছে।

ওই না দেখে আমার মাথা বন বন করে ঘুরতে লাগল। আমি মামাকে জাপটে ধরে রেখেছি। মামারও দেখি আমার মতো দশা। এরই মধ্যে দাদা ছুটে গিয়ে ভূতের কাছে হাজির। প্রথম লাঠি দিয়ে একে একে দুটো হাতই ভেঙে দেয়। এরপর পায়ে জোরে জোরে বাড়ি মারলে ভূতটা নুয়ে পড়ে। দাদা তখন চিৎকার করে আমাদের ডাকছে।' তোমরা এখানে এস। দ্যাখ, ভূতটা মেরে ফেলেছি।

আমি জানি ভূত কখনও মরে না। তাই মামার হাত ধরে ধরে ভয়ে ভয়ে এগোই। গিয়ে দেখি একটা কলাগাছ। সেই ভূত। আমার আর মামার যেন প্রাণ ফিরে এলো। মামাও হাসে, আমিও হাসি। হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যায়। দাদা বলল, 'ভূত দেখা এবং মারা সবই হল। এখন চল। নানাভাই আমাদের জন্য বসে আছেন।' ভোর হয় হয়। এমন সময় আমরা পৌঁছে গেলাম। দৌড়ে নানাভাইয়ের কোলে বসে বললাম, 'আমার জন্য তোমার মনটা কাঁদছিল?'

'হ্যাঁরে। তোকে না দেখলে আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না।' 'জানো নানা, আজ না আমরা ভূতের পাল্লায় পড়েছিলাম। দাদা না থাকলে আমাকে আর মামাকে তো তোমরা খুঁজেই পেতে না।' এ কথা শুনে নানাভাই তো হেসেই খুন। বললেন, 'ওটা তোদের চোখের ভুল।' এদিকে সব শুনে নানি তো মহা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ছুটে গিয়ে পানি পড়া নিয়ে এলেন। বললেন, 'ওদের তিনজনকে পানি পড়া খাইয়ে দিই। কী ভীষণ ব্যাপার, ভূতে যখন ধরেছে তখন এত সহজে ছাড়বে না। আবার সুযোগ পেলেই ধরবে।' আমি বলি, নানি, আগে শোন না।' একে একে সব কথা খুলে বললাম। নানি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। 'যাক বাঁচা গেল। এ যাত্রায় তোরা আসল ভূতের পাল্লায় পড়িসনি। তবে পড়তে কতক্ষণ? নে, একটু একটু করে পানি পড়া খেয়ে নে।'

নানাভাই তখন নানিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'শোনো, তোমার ওই জিনিস আর খাওয়ার দরকার নেই। এবারে ওদের ভুল ভেঙেছে। পৃথিবীতে ভূতটুত বলে কিচ্ছু নেই। আসলে ভূত হল আমাদের চোখের ও মনের ভুল।' নানি মুখ ঝামটা দিয়ে পড়া পানির বোতলটা হাতে করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন,।