পাহাড় পুর | Pahar Pur Bangla Golpo

পাহাড় পুর

শীত যাই যাই করছে। ক'দিন পরই গরম পড়বে। কিন্তু আমাদের স্কুলে বনভোজনের কোনো আয়োজন নেই। আমরা প্রতিদিন টিফিনের সময় আমতলায় বসে এ আলোচনাই করি। 
আসিফ বলল, 'শুধু নিজেরা আলোচনা করলেই হবে? তোমরা তো বড় আপার কাছে যেতে চাও না।
 বড় আপাকে না বললে কিছু হবে?' শেষে ঠিক হল আমি, মনিরা, ঝুমুর, রফিক ও মৌ বড় আপার কাছে কথাটা বলতে যাব। বড় আপা খুব সহজেই রাজি হলেন। তারিখ ঠিক হল ফাল্গুনের মাঝামাঝি। যাব নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর। আমরা খুশি মনে বড় আপার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। 
মনিরা আর ঝুমুর বলল, 'আমরা সালাদ কাটব। আসিফ চুলার কাঠ কাটবে।' আমি বললাম, 'আমি শুধু বসে থাকব। মনিরা বলল, 'তুমি কবে কাজ করো শুনি?' আমি বললাম, 'আমি তো তোমাদের মতো কাজের মেয়ে না।' এ কথায় মনিরা খুব খেপে গেল। ঝুমুর বলল, 'থাক, ঝগড়ার দরকার নেই। 
চল সবাই পিকনিকের আয়োজন করি। যাবার আগের দিন বড় আপা স্যারদের ডেকে আমাদের নিয়ে বসলেন। স্যারকে বড় আপা দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন। 
আমরা যে যার মতো পোশাক পরতে পারব শুনে সবাই খুব খুশি। ঠিক হল সকাল সাতটায় স্কুল গেট থেকে বাস ছাড়বে।
সকাল দশটার দিকে আমরা পাহাড়পুরে পৌঁছলাম। বেশ খানিকটা দূর থেকেই অবশ্য উঁচু পাহাড়ের মতো জায়গাটা দেখা যাচ্ছিল। 
সবাই আনন্দে বলে উঠল, 'ঐ যে!' আমরা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। জহির স্যার রান্নার দায়িত্বে। তিনি বাবুর্চি নিয়ে এক পাশে চলে গেলেন। সবাই খুব খুশি। 
কিন্তু বড় আপা যখন বললেন 'আমি তোমাদের একটা ক্লাস নেব', তখন যেন সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল।
মনিরা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, 'আপা এখানেও ক্লাস?' ঝুমুর কানে কানে বলল, 'যদি পড়া ধরে?'
আমাদেরকে বড় আপা একটা গাছের ছায়ায় নিয়ে গেলেন। আমরা সেখানে বসলাম। বড় আপা বললেন, 'আমি ক্লাস নেব না। গল্প শোনাব। শুনবে তো?' সবাই বললাম, 'আপা, হ্যাঁ।
এখানে শুধু যে আমরাই এসেছি তা নয়। দেখলাম গোটা এলাকাতেই অনেক মানুষ। ওরাও পাহাড়পুর দেখতে এসেছে। আমাদের সামনে বড় আপা দাঁড়ালেন। বললেন, 'আমার কথা শেষ হলে তোমরা বেড়াবে। খুঁটে খুঁটে সব দেখবে, তখন ভালো লাগবে।
' বড় আপা আরো বললেন, 'পাহাড়পুর নাম হলেও এখানে কোনো পাহাড় নেই। এ এলাকা সমতল। যাঁরা এটি তৈরি করেছেন তাঁদের আমলে এ জায়গাটির নাম ছিল সোমপুর।
' আসিফ বলল, 'আপা, কারা এটি তৈরি করেছে?' 'পাল রাজারা', বললেন আপা, 'আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে এটি তৈরি করেন পাল রাজা ধর্মপাল। 
এ বিহারের চারদিকে ১৮ ফুট পুরু দেয়াল ছিল। দরজা ছিল একটি।' ঝুমুর বলল, 'আপা, বিহার কী?' আমার মনে হল ঝুমুরের বোধ হয় এতক্ষণে বিশ্বাস হয়েছে বড় আপা পড়া ধরবেন না। আপা বললেন, 'বিহার হল বৌদ্ধদের মঠ বা মন্দির। 
আগের আমলে বিহার বলতে কেবল বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় বোঝাতো।' মৌ বলল, 'ওরে বাবা, এটা তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বড় আপা দূরে দেখিয়ে বললেন, 'দেখ, ঐ যে মাঝখানে প্রায় ৭০-৮০ ফুট উঁচু, যাকে তোমরা পাহাড় বলছ। ওটা ছিল মন্দির।  আর মন্দিরকে ঘিরে ঘর ছিল ১৭৭টি। ঘরগুলো বেশ বড় ছিল।
এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাস করতেন। লেখাপড়ার জন্য এটা ছিল আদর্শ স্থান। তাদের জন্য গোসলখানা, খাবারঘর, রান্নাঘর সবই ছিল। চল সবাই এখন ঘুরে দেখি।'
সবাই চুন-সুড়কি দেওয়া পথে হাঁটতে লাগলাম। মূল মন্দিরের চারদিকে ঘুরলাম। দেখলাম দেয়ালে বসানো পোড়ামাটির নানা মূর্তি। আমরা দল বেঁধে হাঁটছিলাম। ঘরগুলো দেবে গেছে মাটির নিচে। কিন্তু মনে হচ্ছে জায়গাটা কত পরিচিত। বড় আপার গল্প না শুনলে শুধু হেঁটেই যেতাম, কিছুই বুঝতাম না।
এক জায়গায় দেয়ালের ওপর বসলাম। ভাবছি, আজকের এই পাড়া- গাঁ কয়েক শত বছর আগে কত বড় শিক্ষাকেন্দ্র ছিল।  কত ছাত্র আসতো নানা দেশ থেকে। যেখানে বসে আছি হয়তো কোনো ছাত্র দিনরাত খেটে তাঁর পড়া তৈরি করতেন এখানে।  মনিরা বলল, 'এই চল সবাই, জহির স্যার ডাকছেন, বোধ হয় রান্না হয়ে গেছে।' সবাই খেতে বসলাম। বড় আপাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'এগুলো এরকম হল কীভাবে?' আপা বললেন, 'এক সময় কিছু বিদেশি রাজা আর এদেশের রাজাদের বারবার আক্রমণে এর খুব ক্ষতি হয়। পরবর্তী সময়ের রাজারা আর সাহায্য সহযোগিতা করলেন না। ভিক্ষুরাও চলে গেল অন্য জায়গায়। 
এভাবেই নষ্ট হতে থাকল এত বড় শিক্ষাকেন্দ্র। এখন অবশ্য এটা সরকারিভাবে রক্ষা করা হচ্ছে। 
না হলে এক সময় হারিয়ে যাবে আমাদের অনেককাল আগের এই সম্পদ।' পেট পুরে খেলাম। 
বাসে বাড়ি ফিরছি আর ভাবছি, আরো অনেকবার এখানে আসব। আরো জানব।
Similar Videos

0 comments: