পাথরের সাজা
অনেক দিন আগের কথা। এক গ্রামে বিজু নামে এক বালক বাস- করত। তার খুব শখ শহর দেখতে যাবে। ইচ্ছে হলেই তো আর হয় না। সে সময় একালের মত রেলগাড়ি, ইস্টিমার, উড়োজাহাজ, মোটরগাড়ি কিছুই ছিল না। সে তার মা-বাবার কাছে শহর দেখার জন্য প্রতিদিন আবদার জানায়। অবশেষে অনেক চিন্তাভাবনার পর তাঁরা রাজি হলেন। বাবা তার হাতে ছোট্ট একটা থলে দিলেন।রেখো। শহরে চলাফেরা, থাকা খাওয়ার জন্য টাকাপয়সার খুব দরকার। " মা পথে ঘাটে খাওয়াদাওয়ার জন্য পুঁটলি বেঁধে খাবারদাবার দিয়ে বললেন, 'পথে খিদে লাগলে এগুলো খেয়ো। 'পরদিন খুব সকালে বিজু মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শহরের পথে রওনা দিল। বিজুদের গ্রাম থেকে শহর অনেক দূরের পথ। চলতে চলতে সকাল, দুপুর, বিকেল গড়িয়ে ঠিক সন্ধ্যেবেলায় বিজু শহরের ধারে পৌঁছে গেল। অবাক হয়ে সে দেখে আলোয় ঝলমল করছে সারা শহর। মনে মনে খুব খুশি। এত দিনের শহর দেখার স্বপ্ন তার পূরণ হতে চলেছে। শহর তো তার অপরিচিত। কাউকে চেনে না। শহরের কোথায় কী আছে তাও তার অজানা।
ভাবল, বরং এই সন্ধ্যায় অপরিচিত শহরে না ঢুকে এক গাছতলায়। কোনমতে রাতটা কাটিয়ে দেয়াই ভালো। মায়ের দেয়া খাবার খেয়ে গাছতলায় ঘুমানোর ব্যবস্থাও করে নিল। বাবার দেয়া টাকার থলেটা নিয়েই এখন যত বিপদ। বিদেশ-বিভুঁয়ে টাকা না হলে তো চলে না। যেখানে শোবার ব্যবস্থা হয়েছে তার ঠিক পাশেই বেশ বড়সড় একটা পাথরের খন্ড। বালকটি পাথরের নিচে টাকার থলেটা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
আলোয় চারিদিক ভরে গেছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ। হাতমুখ ধুয়ে মায়ের দেয়া বাকি খাবারটুকু খেয়ে শহরে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিল। যাবার সময় পাথরের নিচে থেকে টাকাগুলো নিতে গিয়ে দেখে থলে নেই। পাথরের আশেপাশে নিচে কোথাও খুঁজে টাকার থলেটা পাওয়া গেল না।
করবে? অসহায় বালক কোনো পথ না পেয়ে কাঁদতে লাগল। শহরের ধারের ওই দিক দিয়ে অনেক লোকের যাতায়াত। পথ দিয়ে যারাই যায় বিজুর কান্না দেখে দাঁড়ায়। কেউ সান্ত্বনা দেয়, কেউ বা টাকার থলেটা খোঁজাখুঁজি করে। পথিকদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।
চুরি হয়ে যাওয়া টাকাটা কোথাও পাওয়া গেল না।
ঠিক ওই সময় শহরের বিচারক তাঁর পাইকপেয়াদা নিয়ে ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। অনেক মানুষের ভিড় আর কান্নারত বালককে দেখে তিনিও থামলেন। বালক ও উপস্থিত সকলের কাছ থেকে বিষয়টি জানলেন। বিচারক তাঁর পাইক-পেয়াদাদের হুকুম দিয়ে বললেন, 'এই চোর পাথরটাকে তুলে নিয়ে আমার আদালতের কাঠগড়ায় হাজির কর।' এ কথা বলে তিনি হনহন করে আদালতের দিকে পা বাড়ালেন।
তার আবার বিচার? এমন আজব বিচারের কথা কি কেউ কোনোদিন শুনেছে? সকলের মধ্যেই অসম্ভব কৌতূহল। এমন আজব বিচার দেখতেই হবে। একে একে সকলেই আদালতে গিয়ে উপস্থিত হল। বিশাল আদালত ঘর। ঘরে ঠাঁই নেই। কৌতূহলী শহরবাসীর ভিড়। বিচারক তাঁর আসনে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। কাঠগড়ার পাটাতনের ওপর পাথরটা। বিচার শুরু হল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। আদালতঘর নীরব।
সামি পাথর হাজির!" বিচারক টেবিলে তিনবার হাতুড়ি পিটিয়ে বললেন, "অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার। আসামি পাথর, নিরপরাধ বালকের টাকাপয়সা চুরি করেছে। সরেজমিনে দেখে মনে হয় পাথরই এ অর্থ চুরি করেছে। তাবে পাথর নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার সুযোগ পাবে। এ সম্পর্কে তার কথা আদালত ধৈর্য সহকারে শুনে ন্যায্য বিচার করবে।'বিচারকের কথা শুনে আদালতে উপস্থিত সকলের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। বিচারক তার হাতুড়ি তিনবার পিটিয়ে আবার বললেন, "অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার। সবাই চুপ করুন। এটি আদালত। বিচারের সময় হাসি-তামাশা করা অপরাধ। এ অপরাধের জন্য আদালত ইচ্ছে করলে শাস্তিদান করতে পারে। সকলেই চুপ করে গেল। বিচারক পাথরকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার নাম এবং বাবার নাম কী? বয়স কত?"
*তুমি কি বালকের টাকাটা চুরি করেছো?? পাথর চুপ।
*টাকাগুলো কোথায় রেখেছো?” পাথরের কাছ থেকে কোন জবাব মেলে না। বিচারক পাথরের কোনো উত্তর না পেয়ে পাথরকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করলেন, *পাথরটি বালকের টাকা চুরি করার জন্য অপরাধী। তাকে ত্রিশ ঘা বেত মেরে হত্যা করা হোক!"রায় শুনে উপস্থিত সকলে হাসি চাপতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই চেপে রাখতে পারে না। আদালত কক্ষের মধ্যে খুক খুক, হি হি, হাঃ হাঃ শব্দ গম গম করতে থাকে। এবার বিচারক জোরে জোরে হাতুড়ি পিটিয়ে সবাইকে চুপ করে থাকতে আদেশ দিলেন। “রায়ের আর একটা অংশ আছে, বলে তিনি ঘোষণা দিলেন "আদালতের বিচার কাজে বাধা দেওয়া এবং আদালতকে সঠিক সম্মান না জানানোর জন্য সবাইকে পাঁচ টাকা করে জরিমানা করা হল।'
ঘোষণা শুনে উপস্থিত সকলেই হতবাক। কিন্তু, আদালতের রায় তো হেরফের হবার নয়। সবাই মানতে বাধ্য। একে একে সকলেই গুনে গুনে পেয়াদার হাতে জরিমানার টাকা দিয়ে তবে রেহাই পেল। বিচারক বিজুকে ডেকে বললেন, “খোকা, এই টাকাগুলো তুমি রাখ। তোমার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করার জন্য শহরের পক্ষ থেকে তোমাকে এই অর্থ দেওয়া হল। আশা করি এ অর্থ দিয়ে তুমি শহর ঘুরে দেখতে পারবে।” জরিমানার টাকা দেওয়ার পর সকলের রাগ গিয়ে পড়ল পাথরের ওপর। সকলে মিলে পাথরটিকে ধরাধরি করে শহরের বাইরে নিয়ে গেল। যে যেমন করে পারে পাথরটাকে আচ্ছা করে দিল মার। তারপর ঠিক হল হত্যা করা হবে। সবাই মিলে পরামর্শ করতে বসল, কীভাবে এটাকে হত্যা করা হবে। অনেক কথাবার্তা হল, পরামর্শ হল, কিন্তু পাথর হত্যা করার কোনো উপায় বের করা গেল না। সকলে বিরক্ত হয়ে পাথরটিকে পথের ধারে ফেলে দিয়ে যে যার মতো বাড়ি ফিরে গেল।
0 comments: