🐦 পাখি হত্যাকারী 🔪
দূর আকাশের কোলে হালকা একটা কালো রেখা। পাখির দল ছুটে আসছে। ঝাঁকে ঝাঁকে। দেখে মনে হয় যেন একখন্ড কালো মেঘ উড়ে আসছে। মকবুল মিয়ার মনে ভয়, যদি পাখিগুলো এখানে না বসে। বাড়ির ওপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে। শোঁ-শোঁ শব্দ। প্রথমে একটা, তারপর একে একে সকলেই সারা গাছপালা জুড়ে বসে যায়। কিচির মিচির শব্দ। বুঝিবা খুশির জোয়ার ছুটেছে। ওরা পানকৌড়ি। অতিথি পাখি। হিমালয়ের ওপারে সেই দূরের সাইবেরিয়া নামের জায়গা থেকে আসে। শীত পড়ার আগে আগে আসে, আবার গরম পড়লে চলে যায়।আজ থেকে পনেরো বছর আগে ওরা এই বাড়িতে প্রথম আসে। তখন সংখ্যা ছিল দুই-তিনশ'। বাড়তে বাড়তে এখন কয়েক হাজার। প্রথম প্রথম মকবুল মিয়া খুব বিরক্ত হতেন। তাড়িয়ে দিতে চাইতেন। মা তখন বেঁচে আছেন। তিনি পাখিগুলোকে আগলে রাখতেন। সারা উঠোন, গাছতলা, টিনের ছাদ ওদের সাদা সাদা মলে ভরে যেত। দুর্গন্ধ ছড়াতো। যখন-তখন ঘরে ঢুকে ধান বা খাবার খেয়ে ফেলতো। তিনি একা হাতে সামলাতেন। ঘরদোর, উঠোন, গাছতলা নিজে পরিষ্কার করতেন। পাখিগুলোকে কিছু বলতেন না। মকবুল মিয়ার মায়ের কাছে পাখিগুলো ছিল সন্তানের মতো। ধীরে ধীরে পাখিগুলো গ্রামের সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। আশ্বিন মাস আসলেই গ্রামবাসী মিলে বিকেল বেলা হাওড়ের ধারে প্রতিদিন অপেক্ষা করে, কখন পাখিগুলো আসবে। এখন পাখিগুলো গ্রামের সকলের সাথী, বন্ধু ও অতিথি।
মকবুল মিয়াদের বাড়িতে আজ খুশির দিন। বিকেল হতেই গ্রামের ছোটবড় অনেকেই খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। আজ এ বাড়িতে সবাই মিলে আনন্দ করবে। গ্রামের যত শিশু আছে আজ সন্ধ্যাবেলায় তাদের পড়তে বসতে হবে না। এই সন্ধ্যায় তাদের ছুটি। অনেকেই উঠোনে জড়ো হয়েছে।
মকবুল মিয়ার দশ বছরের মেয়ে কমলা আর তের বছরের ছেলে শিলু সকলের দেখাশুনা করছে। উঠোনে বড় বড় মাদুর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাদুরে বসে সবাই পাখি দেখছে।
মকবুল মিয়ার বাবা ডালিম মণ্ডল এসে উঠোনে বসেছেন।
এ বাড়িতে তিনিই তো প্রথম পাখিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। ডালে ডালে ছেয়ে গেছে পাখি। নির্ভয়ে বসে আছে। কেউ ডানা ঝাপটায়, কেউবা ঠোঁট দিয়ে গা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত।
কেউ কেউ এ ডাল থেকে ও ডালে গিয়ে বসছে। একটানা কিচিরমিচির শব্দ।
কমলার মা রান্না ঘরে খুব ব্যস্ত। পাড়ার মেয়েরাও তাকে সাহায্য করছে। বড় বড় হাঁড়িতে পায়েস রান্না হচ্ছে। গত দশ বছর ধরে ডালিম মণ্ডল এই দিনে গ্রামের সকলকে মিষ্টিমুখ করান। বড়রা কলাপাতা কাটতে ব্যস্ত। কলাপাতায় পায়েস খেতে দেওয়া হবে।
উঠোনে হ্যাজাক জ্বালানো হয়েছে। মাদুরে বসে সবাই হাপুসহ্রপুস শব্দে পায়েস খাচ্ছে। শিশুদের হৈ চৈ, বড়দের হাঁকডাক। সে এক মহা হুলস্থুল কাণ্ড। সন্ধ্যা শেষ হয়েছে বেশ আগে। একে একে সবাই চলে গেছে। কমলার মা উঠোনে ছড়ানো-ছিটোনো কলার পাতা গুছিয়ে রাখছেন। কমলা, শিলু খুব খুশি। দুই ভাইবোন গল্পে মশগুল। মকবুল মিয়া গোয়াল ঘরে গরুছাগলগুলো দেখছেন।
ডালিম মণ্ডল ধীরে ধীরে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েন।
মনে পড়ছে তাঁর পনেরো বছর আগের কথা। প্রতিবেশী, গ্রামবাসী কেউই পাখিগুলোকে পছন্দ করত না। কত না উৎপাত করেছে। মকবুলের মা আর তিনি দুইজন মিলে রক্ষা করেছেন পাখিদের। আজ আর মকবুলের মা নেই। তিনি যেন পাখিদের প্রতি তাঁর যে মায়া তা সকল গ্রামবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। প্রাণ দিয়ে সকলেই তাঁদের সহযোগিতা করে। দূর এলাকা থেকে কত লোক এই দিনে পাখি দেখতে আসে।কার্তিকের ভরা পূর্ণিমার গভীর রাত। চারিদিকে নীরব নিশ্চুপ। সারা গ্রাম ঘুমে অচেতন। পাখিরাও ঘুমায়। মাঝে মাঝে শুধু ডানার ঝটপটানি শোনা যায়।
হাওড়ের পানিতে চাঁদের আলোর ঝিকিমিকি।
মাঝে মাঝে টুপটাপ মাছের শব্দ ওঠে পানিতে। রাত প্রায় শেষ। বড়জোর ঘণ্টা দুয়েক বাকি। মকবুল মিয়ার ঘুম ভেঙে গেছে। জানালা দিয়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্নার আলো ঘরে ঢুকেছে। ঠিক সেই সময় বটগাছের দিক থেকে খস খস পাতার আওয়াজ শুনতে পান মকবুল মিয়া। মনে হয় কেউ যেন সাবধানে পা ফেলে ফেলে আসছে। মকবুল মিয়া নিঃশব্দে দরজা খুলে বের হন। পা টিপে টিপে একটু ঘুর পথে বটতলায় আসেন। একটা লোক বটগাছের ডালে বসা পাখির দিকে গুলতি তাক করে আছে।
মকবুল মিয়া লোকটাকে পেছন থেকে জাপটে ধরেন। চিৎকার করে ওঠেন। চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন মুহূর্তেই বেরিয়ে আসে। কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে বল্লম বা সড়কি। লোকটা এই গ্রামেরই এক যুবক। নাম তার শুকুর। কেউ বলছে ওর হাত ভেঙে দাও। কেউ বলছে, না, দুই ঠ্যাং। কেউবা চায় পিঠমোড়া করে বেঁধে মনের সুখে পেটাতে। ঠিক তখন বাঁকা বেতের লাঠি হাতে ঠক ঠক করতে করতে ডালিম মন্ডল সামনে এসে দাঁড়ান। তাকে দেখে সবাই থেমে যায়। চুপচাপ, কোন শব্দ নেই।
সকলের মধ্যেই কৌতূহল। এখন কী হবে? ফিস ফিস করে সকলে কথা বলছে। ডালিম মণ্ডল শুকুরকে বসতে বললেন। ভোর পর্যন্ত বসে থাকতে হবে। কথা বলা নিষেধ। নড়াচড়া করা যাবে না।
ভোর হতে এখনও বেশ বাকি। নানান বয়সী পাহারাদারের দল উঠোনে বসে আছে।
কমলা ও শিলু দলের মধ্যে বসা। কমলা বলে, 'চুপ করে বসে না থেকে বরং সকলে মিলে গান গাই।' কমলার কথায় সকলেই খুশি। গান শুরু হয়।
গানে গানে কখন যেন ভোর হয়ে যায়। ডালিম মন্ডল লাঠি হাতে এসে উঠোনে দাঁড়ান।
ডালিম মন্ডল শুকুরের দিকে তাকিয়ে বলেন, 'এমন সুন্দর পাখি মারতে তোমার কি হাত একটুও কাঁপল না? পাখিগুলো আমাদের বিশ্বাস করে। আমাদের আশ্রয়ে থাকে। আমরা সকলেই ওদের ভালোবাসি। এই অন্যায় কাজের জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। যাতে সারা জীবন তোমার মনে থাকে।
এই কথা বলে ডালিম মণ্ডল শুকুরের গলায় গুলতিটা মালার মতো ঝুলিয়ে দিলেন। শিশুদের ডেকে বললেন, 'ওকে এই ভাবে সারা গ্রাম ঘুরিয়ে নিয়ে এস। আগে আগে শুকুর হাঁটে, পিছনে শিশুর দল। যেন এক মহা আনন্দের মিছিল। শিশুরা পিছন পিছন দল বেঁধে ছুটছে আর বলছে,
🐦পক্ষীঘাতক শুকুর এ গ্রামের।
শিশুরা ছড়া কাটতে কাটতে গ্রাম ঘুরতে থাকে। মিছিল নিয়ে ছুটতে ছুটতে শিশুরা চোখের আড়ালে চলে যায়। এক সময় ওদের হৈ চৈ আর শোনা যায় না। ডালিম মণ্ডল লাঠিতে ভর দিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছেন। ভাবছেন সেই পনের বছর আগেকার কথা। এই সময় মকবুলের মা থাকলে খুব খুশি হত।
👇👇👇👇👇👇👇👇👇👇👇👇👇
0 comments: